নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ খুলনার ফুলতলা উপজেলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির তৎপরতা কমলেও তাদের স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে।
যারা এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন তারা এখনও পলাতক। তার আত্মগোপনে থেকে কিশোরদেরকে মদদ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই কিশোরের দল ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় ওই কিশোর গ্যাংটির নানা কর্মাকাণ্ড নজরে এসেছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থার।
তাদের প্রতিবেদন বলছে, উপজেলায় ২০ থেকে ২৫ জন কিশোরের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ‘হাসনাত বাহিনী’ নামের দল। এদের নেতৃত্বে এলাকায় মাদক কারবার, জুয়া, ছিনতাই, স্কুল ছাত্রীদের উত্যক্ত করা, গভীর রাতে মোটরসাইকেল মহড়া, ভয় ভীতি প্রদর্শন চলে। হুমকি-ধমকি, অপমান-অপদস্ত ও মারপিটের ভয়ে কেউ বিরোধিতা করে না, থানায়ও অভিযোগ দিতে সাহস পায় না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন পলাতক নেতারা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে মূলত ওই কিশোর গ্যাং তৈরি করেছেন। এসব কিশোরদের মধ্যে কেউ কেউ বালু ব্যবসায়ী, পানের দোকানি, ভ্যান চালক, পাপড় বিক্রেতা ও মিল শ্রমিক পেশায় জড়িত।
তাদের বিভিন্ন সময়ে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে চরমপন্থি সংগঠনের পলাতক নেতার এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা নেতিবাচক কার্যক্রম চালায়।
গত ৩১ মার্চ খুলনার ফুলতলা উপজেলায় সৈয়দ আলিফ রোহান নামে ২২ বছর বয়সী এক ছাত্রকে এম এম কলেজের ভেতরে দিনে-দুপুরে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনায় করা মামলার এজাহারে পাঁচ কিশোরের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ইভটিজিংয়ে বাধা দিয়ে খুন
আলিফ রোহানকে হত্যার ঘটনায় তার বাবা সৈয়দ আবু তাহেরের করা মামলায় আসামি দীপ্ত সাহাকে ১ এপ্রিল বিকেলে ফুলতলার দামোদর এলাকার নিজবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
দীপ্তর প্রাথমিক স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, কয়েক দিন আগে পায়গ্রাম কসবা এলাকার একটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়। ওই অনুষ্ঠানে কয়েকজন মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছিল। এতে বাধা দেন আলিফ।
এ ঘটনায় ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে আলিফকে ‘শিক্ষা’ দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ৩১ মার্চ আলিফ ফুলতলা এম এম কলেজে ক্লাস করতে গেছেন, খবর পেয়ে তারা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে কলেজে এসে তাকে ছুরিকাঘাত করে।
কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সকালে এসে আলিফ ক্লাস করেছিল। পরে কলেজে দ্বিতীয় ফটকের সামনে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। এ সময়ে এক শিক্ষক চিৎকার করলে আমরা গিয়ে দেখি, আলিফকে হত্যা করে খুনিরা পালিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যে ছেলেরা আলিফকে হত্যা করেছে, তারা সামাজের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অনেকে বলছেন তারা মাদক বিক্রি করে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অনেককে তারা হত্যার হুমকি ও মারধর করেছে।’
কিলিং মিশনে পাঁচ জন মামলার এজাহার, গ্রেপ্তার আসামির স্বীকারোক্তি ও প্রতক্ষ্যদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আলিফকে হত্যার জন্য চারটি মোটরসাইকেলে করে ৮ থেকে ৯ কিশোর কলেজে এসেছিল। তার মধ্যে হত্যায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল পাঁচজন। তারা হলেন, তাছিন মোড়ল, সাব্বির ফারাজি, শান্ত গাজী, দিপ্ত সাহা ও আবুল হাসনাত।
তারা আলিফকে কলেজের উত্তর গেট সংলগ্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। পরে দিপ্ত সাহা, আলিফের দুই হাত চেপে ধরে। তখন তাছিন, আলিফের বুকের ডান পাশে ছুরিকাঘাত করে। এরপর শান্ত গাজী, আলিফের গলা চেপে ধরে। অতপর সাব্বির আবার তার পেটের বাম পাশে ছুরিকাঘাত করে। সবশেষে হাসনাত তার পিঠের মেরুদণ্ড বরাবর ছুরিকাঘাত করে। পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসলে তারা সেখান থেকে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
ফুলতলা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আলিফের শরীরে মোট তিনটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আলিফকে হত্যা সরাসরি জড়িত ছিল ওই পাঁচ জন। তাদের নামে থানায় মামলা হয়েছে।’এখনো রেপরোয়া গ্যাং এ হত্যার পরে পুলিশ আসামি দীপ্ত সাহাকে গ্রেপ্তার করলেও বাকি চারজন পলাতক। তাদের সঙ্গীরা বাদীপক্ষকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মামলার বাদী সৈয়দ আবু তাহের বলেন, ‘তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। এখন আমার পরিবারের বাকি সদস্যদের হত্যার চেষ্টা করছে যাতে মামলা কারার কেউ না থাকে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্নভাবে ইঙ্গিত পাচ্ছি, এসব কিশোরদের মদদে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা রয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক একটি গোষ্ঠীও ওই কিশোরদের বাঁচাতে চেষ্টা করছে।’
যা বলছে পুলিশ
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলতলা থানার তদন্ত পরিদর্শক এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এ হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল দীপ্ত সাহা। তাকে গ্রেপ্তার করার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার অগ্রগতি হয়েছে।’
ওসি ইলিয়াস তালুকদার বলেন, ‘ফুলতলার একটি কিশোর গ্রুপের সদস্যরা একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের প্রশ্রয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় কলেজছাত্র খুনের ঘটনা ঘটেছে। ওই গ্রুপের বাকিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
এসব কিশোরদদের সঙ্গে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কোন সম্পৃক্ততা আছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের তদন্ত চলছে।’