নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আওয়ামীলীগ এর পদে থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য,পকেট কমিটিসহ নানা অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রাজশাহীর আলহাজ্ব সুজাউদৌলা ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ. এস. এম মুস্তাফিজুর রহমান (মানজাল)। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৬ সালে দলীয় প্রভাবে নিয়োগ নিয়ে অধ্যক্ষের পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি।
সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেছেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর কলেজ গভর্নিং বডির গঠিত অভ্যন্তরীন অডিট কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সাবেক অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও অবৈধভাবে বিপুল অর্থ সম্পদ অর্জনের তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক,কর্মকর্তারা। এছাড়াও রাজশাহীর আদালতে তার বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হয়েছে। সাবেক অধ্যক্ষ মানজালের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
অভিযোগে বলা হয়, গত ২৫ আগস্ট অধ্যক্ষের পদ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কলেজ থেকে পালিয়ে যান। অভিযোগ রয়েছে সে সময় নগদ ২০ লক্ষ টাকা এবং দুর্নীতির প্রমাণ মুছে ফেলতে রেজুলেশন খাতা ও কলেজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নিয়ে যান। এ. এস.এম মুস্তাফিজুর রহমান মানজাল ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কলেজের দায়িত্বে ছিলেন। চাকুরিকালীন সময়ে সাবেক মেয়র এইচএম খাইরুজ্জামান লিটন ও তার স্ত্রী শাহীন আক্তার রেনীর আস্থাভাজন ছিলেন মানজাল। তিনি নিজেও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে অন্যতম মদদদাতা ছিলেন মানজাল। ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান না করে লুটপাটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ তছরুপ করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির অডিটে তার বিরুদ্ধে ছাত্রদের বেতন ও পরীক্ষার ফি বাবদ ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ৫২ হাজার ১৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। শিক্ষক, কর্মচারী কর্মকর্তাদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে একাউন্ট থাকলেও তিনি সেখানে লেনদেন করতেন না। প্রতিষ্ঠানের আদায়কৃত সকল অর্থ তিনি নিজের কাছে রাখতেন এবং নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করতেন। প্রতিবছর অডিট হলেও পকেট কমিটির মাধ্যমে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেগুলো ম্যানেজ করতেন। খবর নিয়ে জানা গেছে সাবেক অধ্যক্ষ মানজালের পবা উপজেলায় ৩০ বিঘা ও ২০ বিঘার দুটি পুকুর রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আলিশান বাংলো বাড়ি। সেখানেও নারী নিয়ে ফুর্তি করতেন তিনি।
অভ্যন্তরীণ অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিগত ৮ বছরে ভর্তি ফি, বেতন, সেশন চার্জ, ফরম পূরণ, পরীক্ষার ফি, অনুদান ও টিফিন বাবদ প্রতিষ্ঠানের আয় হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লক্ষ ৫৯ হাজার ১৬৮ টাকা। এর বিপরীতে খরচ দেখানো হয়েছে ২৫ লক্ষ ০৭ হাজার ১৫২ টাকা। এরমধ্যে কলেজের বোর্ড ফি ও কেন্দ্র ফি বাবদ দেখানো হয়েছে ১৯ লক্ষ ৪১ হাজার ৫৭১ টাকা এবং কলেজ উন্নয়নে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার ৫৮১ টাকা। বাকি ১ কোটি ৭৩ লক্ষ ৫২ হাজার ১৬ টাকার কোন হদিস নেই। শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীরা বলছেন পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করেছেন সাবেক অধ্যক্ষ মানজাল।
গত ২২ সেপ্টেম্বর দুদকে দেয়া আবেদনে বলা হয়েছে আলহাজ্ব সুজাউদ্দৌলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ এস এম মুস্তাফিজুর রহমান বিগত ২৫ আগস্ট অধ্যক্ষের পর থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ছিলেন। সে সুবাদে তিনি কলেজের কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করতেন না। সব সময় তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কলেজ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে অপমান অপদস্ত করতেন, যাতে আমরা তার বিরুদ্ধে কোন নিয়ম নীতির কথা বলতে না পারি। এছাড়াও সদ্য পদত্যাগকারী অধ্যক্ষ এ এস এম মুস্তাফিজুর রহমান তার অফিস কক্ষের পাশেই তার তৈরিকৃত গোপনকক্ষে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে মহিলা শিক্ষক, মহিলা অভিভাবক, এমনকি ছাত্রীদের পর্যন্ত অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার জন্য কুপ্রস্তাব দিতেন, যেগুলো প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। আবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, পদত্যাগের পর বিগত ৮ অক্টোবর ও ১৯ অক্টোবর গভর্নিং বডির সভার সিদ্ধান্তক্রমে অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি কলেজের বিভিন্ন খাতে আদায়কৃত ১ কোটি ৭৩ ল্ক্ষ ৫২ হাজার ১৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও তিনি কলেজের বিভিন্ন পদে নিয়োগকৃত বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে অবৈধভাবে অর্থ গ্রহণপূর্বক বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলেও আবেদনে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে রাজশাহীর আদালতেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেখানে অর্থ আত্মসাৎ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, শিক্ষক কর্মচারীদের নির্যাতন, অপমান অপদস্থসহ গোপনকক্ষে নারি কেলেঙ্কারীর অভিযোগ আনা হয়েছে।
এত অপকর্মের পরও কলেজের শিক্ষক কর্মকর্তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন সাবেক অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান মানজাল। এ নিয়ে গত ২৬ অক্টোবর নগরীর রাজপাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো: আলমগীর হোসেন।এদিকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অধ্যক্ষ মানজালের স্ত্রী সালমা আক্তারকে প্রদর্শক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। যা ২০০৭ সালের অডিট রিপোর্টে ধরা পড়ে। কিভাবে নিয়োগ হলো সে বিষয়ে তৎকালীন অধ্যক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময় কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয় । পরবর্তীতে তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান মানজাল ২০১৭ সালে কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করলে সালমা পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। অভিযোগ রয়েছে কলেজের টাকা নিজের মতো করে খরচ করতেন সালমা আক্তার । করতেন বিলাসী জীবনযাপন।
অন্যদিকে সাবেক অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান মানজালের চাচা শ্বশুর ফিরোজ কবির সেন্টু একই কলেজে চাকরি করেন আইসিটি বিষয়ের প্রদর্শক পদে। তার নিয়োগ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে তাকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেন্টু বর্তমানে রাজশাহী মহানগরের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। সে সময় পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই গত ১৪ জুলাই থেকে কলেজে অনুপস্থিত সেন্টু। এখন পর্যন্ত কলেজে যোগ দেননি তিনি। নিয়ম অনুযায়ী তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করেছে কলেজ গভর্নিং বডি । অন্য পদে থাকলেও সাবেক অধ্যক্ষ মানজালের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন তিনি । কলেজের কাছেই তার বাড়ি হওয়ায় প্রকাণ্ড দাপটে মুখ খুলতে পারতেন না শিক্ষক, কর্মকর্তা -কর্মচারীরা।
তবে বর্তমানে কলেজের আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত চান শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্তদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি।