নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ক্ষিত্র লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাকির পিতা ফকির নামে এক গাছি রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করছেন খেজুরগাছ ২০০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
কার্তিক শেষে আজ (শনিবার) থেকে শুরু অগ্রহায়ণ। এরই মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে পুরোপুরি শুরু হয়েছে শীতের আবহ। সকাল-সন্ধ্যায় পড়ছে হালকা কুয়াশা। কমতে শুরু করেছে দিনের তাপমাত্রা। এরই মধ্যে শীতের সকালে খেজুরের রস সংগ্রহের সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন গাছিরা। এখন শুধু অপেক্ষা রস সংগ্রহের।
চলতি শীত মৌসুমে (২০২৪-২৫ অর্থবছর) রাজশাহী জেলায় খেজুরের গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ টন। এ বছর ১৭৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে চাঙ্গা হয়ে উঠবে রাজশাহীর অর্থনীতির চাকা। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খেজুরের রস ও গুড়ের জন্য জেলার দুর্গাপুর, বাঘা, পুঠিয়া ও চারঘাট উপজেলা এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছে। রাজশাহীর প্রায় ২৮ হাজার পরিবারের সংসার চলে খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫৪৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে ১১ লাখ ১১ হাজার ৩৪৩টি গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে এরই মধ্যে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আর এই খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির সঙ্গে এবার রাজশাহীর ৪৯ হাজার ৭১১ জন চাষি সম্পৃক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া এবার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৯০টি গুড়ের আড়তে ৬৪৪ জন গুড় ব্যবসায়ী ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন।
সম্পৃক্তরা বলছেন, খেজুরের রস না হলে রাজশাহীতে শীত জমেই না। কুয়াশাভেজা গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানোর দৃশ্য কিংবা বাড়ির উঠানে গুড় পাকানোর আয়োজন, হরেক পদের পিঠাপুলি শীতের আমেজকে করে তোলে উৎসবমুখর। ইতোমধ্যে দা-দড়ির সাহায্যে খেজুরগাছ পরিষ্কার করে মাটির ভার লাগানোর ধুম পড়ে গেছে। এ যেন বাংলার চিরায়িত রূপ। কিছুদিন পরই গ্রামে গ্রামে ধুম পড়বে রস সংগ্রহের। রাজশাহী জেলা খেজুরের রস, গুড় আর পাটালির জন্য প্রসিদ্ধ। এ জেলায় রাস্তার ধারে, জমির আইলে আর ছোট ছোট জমিতে খেজুরের গাছের সমারোহ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
খেজুরের গুড় সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় বাঘা উপজেলায়। এই এলাকার চাষি আনোয়ারুজ্জামান বলেন, আমার প্রায় ১০০টি খেজুরগাছ রয়েছে। পাশের বাজুবাঘা বাজারে গুড় বিক্রি করি। পাশাপাশি অনলাইনে সারা দেশে ভেজালমুক্ত খেজুর গুড় সরবরাহ করি। প্রতি বছরের মতো এবারও অনলাইনে গুড় বিক্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে রসের জন্য গাছ প্রস্তুত করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে রস সংগ্রহ শুরু হবে। এরপর বাড়ির আঙিনায় তৈরি হবে গুড়। বাঘার আড়ানি পৌরসভা এলাকার গাছি আনসার
আলী বলেন, আমার ৭০টি গাছের সঙ্গে আশপাশের কয়েকজন মালিকের কাছ থেকে আরও ৮০টি গাছ ইজারা নিয়েছি। প্রতিটি গাছের জন্য মালিককে প্রতি সপ্তাহে দিতে হবে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। এসব গাছ থেকে আর কয়েক দিনের মধ্যে রস আহরণ করা শুরু হবে। শীত জেকে বসলে একটি প্রাপ্তবয়স্ক খেজুরগাছ থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ১০ লিটার রস পাওয়া যায়। গত শীত মৌসুমে দেড়শ গাছের রস থেকে গুড় তৈরি করে প্রায় চার লাখ টাকা আয় হয়েছে। এ ছাড়া আমার সঙ্গে ৪৫ জন কর্মী কাজ করেন।দুর্গাপুরে ক্ষিদ্র লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাকির, পিতা: ফকির ও দুর্গাপুরের আমগাছি গ্রামের গাছি শরিফুল ইসলামবলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি তিন মাস আমরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করি। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে থাকি। গাছ পরিচর্যা ও রস সংগ্রহের জন্য গাছ মালিক আমাদের প্রতিদিন ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক দেন। পুঠিয়ায় বানেশ্বর, ঝলমলিয়া ও বাঘা উপজেলা সদরে সপ্তাহে দুদিন খেজুরের গুড়ের বড় হাট বসে। এ তিনটি হাটেই সবচেয়ে বেশি গুড় বিক্রি করেন গাছিরা। এখানকার কারিগরদের দানা ও পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যাপক সুনাম থাকায় চাহিদাও রয়েছে বেশি। বাঘার মেসার্স আপেল অ্যাগ্রোর মালিক আপেল হোসেনবলেন, সপ্তাহে রবি ও বৃহস্পতিবার বাঘায় গুড়ের হাট বসে। শীতের সময় প্রতি হাটে শতাধিক টন গুড় বেচাকেনা হয়। ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ গুড় যায়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘একটি খেজুরগাছ ৬-৭ বছর দেকে শুরু করে ২৫-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত রস দেয়। রস সংগ্রহের উপযোগী করতে কার্তিকের শুরু থেকেই গাছিরা খেজুরগাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলেন। এখন রাজশাহীর ১১ লক্ষাধিক খেজুরগাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। শীত আরেকটু বাড়লেই কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে রস সংগ্রহের উৎসব।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে এসব গাছ থেকে রস প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্রায় ৮ হাজার ৯০০ টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ থেকে প্রায় পৌনে ২০০ কোটি টাকা বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খেজুরের রস ও গুড় থেকে গত মৌসুমে ১৪১ কোটি ৮২ লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছে।ছবি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ক্ষিদ্র লক্ষ্মীপুর গ্রামের সাকির, পিতা: ফকির নামে এক গাছি।