
“ফাইল নাম্বার ৬৩৩”
মহাম্মাদ শাওন/// শেষ পর্ব
পূর্বের পর্ব পড়তে ভিজিট করুন www.Foxnewsbd.com ও ফক্সনিউজ বিডি ফেসবুক পেজের উন্মুক্ত লিখনিতে।
দুপা চলে থেমে গেলাম, তারপর আমার চারিদিকের পরিবেশ মুহূর্তের মধ্যেইবদলে গেল প্রতিটা রংচটা দেয়ালে যেন রঙের আস্তর পড়ে গেল পুরো বাড়ি যেন হাসির শব্দে ঝনঝন করে উঠলো আমার পাশ দিয়ে যেন অল্প বয়সি অনেকগুলো মেয়ে হাসতে হাসতে ছোটাছুটি করতে শুরু করলো.. তাদের কাছে আমার অস্তিত্ব যেন মূল্যহীন আমিতো সেখানে জলজ্যান্ত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছি আমাকে তারা দেখেও দেখছে না. বাইরের ঘর থেকে ভেসে আসছে আরো আওয়াজ আরো দুপা হেঁটে বাহির ঘরে ঢুকে দেখি এক রমণী অভূতপূর্ব নৃত্য প্রদর্শন করছে আর হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছে তার রূপলাবণ্য যেন কোন অপ্সরার চেয়ে কম নয়।
পরের দিন সকালে যখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম ততক্ষণে পুরো নাটকের উপর পর্দা পড়ে গেছে আমি শুয়ে আছি আর বিছানায় পাশে বেলাল ঘুমিয়ে। তাহলে আমি কি তখন ….ও হতে পারে স্বপ্ন হতে পারে নিজেকে একটা তাচ্ছিল্য পূর্ণ হাসি দিয়ে সকাল সকাল নদীতে গেলাম একটা গোসল দেওয়ার জন্য। গোসল দিয়ে হালকা খেয়েদেয়ে দুজনে বের হলাম একটু গসালা টা ঘুরে এবং বাহিরের গ্রামটা একটু ঘুরে আসবো বলে.
-কি হে, মোহন সবকিছু ঠিক আছে তো? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলো বেলাল।
-জি বাবু সবকিছু ঠিক আছে। শুধু এদের একটু শুকনো খাবার কমে গিয়েছে তার জন্য অবশ্য গ্রামের পাটোয়ারীকে বলে এসেছি। পাটোয়ারীর একটা ব্যবসা আছে সে দিয়ে যাবে সব রকমের দানা খাবার
-আচ্ছা আচ্ছা ভালো করেছো, কত পয়সা হয় পরে একটা রশিদসহ পাঠিয়ে দিও। বলে বেলাল গাভীগুলোর কাছে এগিয়ে গেল।
পরে মোহন যতটা সম্ভব আমার কাছে এগিয়ে এসে ঝুঁকে ফিশ ফিশ গলায় বলল
-বেলাল বাবুর কি জ্বর হয়েছিল?
– না সে তো একদম সুস্থ আছে।জ্বর হতে যাবে কেন?
-অপরাধ নেবেন না বাবু। আপনারা গত সপ্তাহ খানেক থেকে বাড়ি থেকে বের হন নি তো, তাই আরকি জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনাকে শুধু একটু বারান্দায় বসে থাকতে দেখি কিন্তু বেলাল বাবু তো বাহিরে বের হন না তাই আপনার কাছে.. -একথা বলেই মোহন চলে গেল।
আমি যেন অবাক হয়ে গেলাম। আমি যে ডানপিটে ছেলে এক দন্ড স্থির থাকতে পারিনা সে কিনা এক সপ্তাহ থেকে বাড়ি থেকে বের হয়নি। সেই দিন প্রথম দিন যেদিন আমি বুঝতে পারলাম বাড়িটা আমাকে তার মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি ধুপ করে উঠলো। তারপর মুহূর্তে একটা দমকা হাওয়াএসে শরীরে স্পর্শ করতেই পুরো শরীরের যেন ভার হারিয়ে গেল। নিজেকে তুলারন্যায় হালকা মনে হচ্ছিলআমি সবকিছু বুঝেও যেন বেলালকে কিছুই বলতে পারছি না।
তারপরে মনটার মধ্যে চাঞ্চল্য ভাব ফিরিয়ে এনে ঠিক করলাম না এইভাবে আর চলা যায় না কাল এ বাড়ি থেকে অন্য কোন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করব। খামাখা বেলালকে এইসব বলে ভীত করার কোন প্রয়োজন নেই।
বাড়ি ফিরে দেখি সেই মেয়ে এসে রান্নাবান্না করে খাবারগুলো অন্য একটি খালা দিয়ে ঢেকে রেখে চলে গিয়েছে। দেরি না করে আমি আর বেলাল দুপুরের খাবারটা সেরে ফেললাম।
ভাই বেলাল, রেঁধেছে কিন্তু খাসা-বলতেই বেলাল একগাল তুলে নিয়ে বলল-রূপে-গুণে এ টইটুম্বর।
তাই নাকি- বলে তার সাথে ঠাট্টা জুড়ে দিলাম।
টানটান ভরপেট খেয়ে বেলাল দুপুরের পর একটা ঘুম দিয়ে দিল আমি দুয়েকবার এপিঠ-ওপিঠ করে
ঘুম না আসায় উঠে আরাম কেদারা টানিয়ে বাড়ির পেছনদিকে ঘাটের কাছে বসে পড়লাম। মনে মনে ভাবছিলাম আজ বিকেলে একবার মোহনকে বলে দেখি কোথাও একটা থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে তো বলেছিল সে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। এইসব ভাবতে ভাবতে একদৃষ্টে বনের দিকে দেখতে ছিলাম এরইমধ্যে পেছন থেকে খুব মিষ্টি গলার স্বর কানে আসলো যেন আকুতি করে বলছে-তুমি কেন চলে যাবে। যেওনা আমাকে ছেড়ে। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই বুকের মধ্যটা ধুক করে উঠলো। তারপর আর কিছু মনে নেই পরে সন্ধ্যার দিকে বেলাল ডাক দিতেই চোখ খুলে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশটা খারাপ করেছে পূর্ব-পশ্চিম কোন থেকে ভেসে আসছে রাশি রাশি মেঘ, ঘন কালো মেঘ। সন্ধায় নাস্তার পর আমি আর বেলাল সেই রাতে কিছু খেলাম না বাড়িময় পাঁয়চারা করে শুয়ে পরলাম। পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো ঘুম থেকে উঠার সময় মনে হচ্ছিল শরীরটা যেন বেশ ক্লান্ত শরীরটা কেমন যেন ম্যাচ ম্যাচ করছে। বাহির জানালায় তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। লাইট টাও চলে গিয়েছে কোনমতে হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার টা তৈরি করে নিলামবুঝতে পারছিলামবাহিরে যে রকমের বৃষ্টি হচ্ছে তাতে করে ওই মেয়ে আজ বুঝি আর কাজে আসা হবে না তাই বেলালকে বললাম খাবারের জোগার করতেকিন্তু আমাকে অবাক করে বেলা আন্দাজ এগারোটা কাছাকাছি সে কাজে আসলো বেলাল ও তাকে সাহায্য করছিল। আমি দিব্যি বুঝতে পারছিলাম দিন দিন বেলালের শরীরটা কেমন জানি কমে আসছে চোখের নিচে কেমন একটা দাগ পড়ে গেছে আমার হাতের পায়ের রগ গুলো বের হয়ে এসেছে শরীরটা কেমন জানি নেতিয়ে পড়ছে ঠিক করলাম একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার ঠিক আছে আজ বিকালে না হয় একবার বেলাল কে বলে দেখি এই চিন্তাটাই করে রাখলাম কিন্তু এমনটা হলো না। সন্ধ্যার কিছু আগেই বৃষ্টি যেন বিরাট এক ঝড়ের আকার নিল। মোহিনী কে বললাম সে যেন এই ঝড়ে আর বাড়ি না। ফেরে এখানেই থেকে যায় ভাবছিলাম যে সে হয়তোবা সংকোচ করবে সে কিন্তু তার ভাবে কোনো সংকোচের পরিব্যক্তি আমি দেখলাম না বরং সে অনেক বিনয়ের সাথে একটা ধন্যবাদ দিল শুধু। অবশ্য সাড়ে সাতটা আটটা বাজতে বাজতে বৃষ্টি থেমে গেল। সে বাড়ির বাহিরে বারান্দায় থাকতে চাইল মেয়ে মানুষ তাই আমিও জোর দিয়ে কিছু বললাম না।
সেদিন মাঝরাত্তিরে আমার ঘুম ভাঙলো ক্ষীণ এক ধরনের অস্বাভাবিক আওয়াজেআমি বুঝতে পারছিলাম না শব্দ টা কিসের যেন আমার পুরো শরীরে ঘুমের মধ্যেই আছে কিন্তু আমার মন জাগ্রত সে বাহিরের সবকিছু বুঝতে পারছে চোখ খুলে উঠে দাঁড়াতেইবুঝতে পারলাম কারা যেন ঘর থেকে ছুটে এদিক-ওদিক পালিয়ে গেলদ্রুত হাটার পায়ের শব্দ ,ঝনঝনিয়ে পড়া অর্থের ঝুনঝুনি, কোমল হাসির শব্দঘাট থেকে যেন ভেসে আসছে,একদল অল্প বয়সীরমণীর হাসিঠাট্টার শব্দ আর কিছু পরেইবাতাসের সাথে ভেসে আসলো এক ধরনের করা সুবাস যেন চন্দ …..
….চন্দন গোলাপের মিশ্রিত এ এক মনমুগ্ধকর সুবাস কিছু পরেই সবকিছুর মধ্যে এক পর্দা দিয়ে ভেসে আসলো কারো আর্তনাদের শব্দ কেউ জানো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার সাথে আছে প্রচন্ড ব্যাথার আর্তনাদ আমি যেন মোহিত হয়ে এক পা এক পা করে হেঁটে ঘরের দরোজা ঠেলে বাহির ঘরে তাকাতেই দেখি সেখানে শেকল দিয়ে একটা মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছেসে সে যেন হাত বাড়িয়ে আমার থেকে সাহায্যর আকাঙ্ক্ষা দেখাচ্ছে। তারপরও মুহূর্তে ইশারা করে বলছে চলে যাও চলে যাও। কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠলো এবং তার সাথে সাথেই মাটিতে একটা নিস্তেজ শরীর হয়ে লুটিয়ে পরল আমি যেন এক হতবাক শ্রোতা-দর্শক হয়ে সবকিছু দেখছি। মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের পুরো চিত্র যেন আবার পরিবর্তন হয়ে গেল একটু আগেই যেখানে লুটিয়ে পড়েছি লএকটি দেহ, এখন আর তা সেখানে নেই। তার বদলে সেখানে একসুন্দরী তরুণী নৃত্য প্রদর্শন করছে। তার সাথে কানে ভেসে আসছে সেটার তবলা আর মধুর সংগীত। অঙ্গ ভঙ্গিমায় আমাকে তার দিকে ডাকছে। আমার মনের মধ্যটাকেমন জানি কুলুষিত হয়ে উঠলো। কি যেসব লোলুপবাসনার আনাগোনা মনের মধ্যে করতে লাগলোতা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এই সবকিছুর মায়া জালে জড়িয়েআমি যেন হাসতে শুরু করে দিলাম, প্রচন্ড হাসি। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেইবেলাল এসেঘাড়ে হাত দিয়ে একটা ঝাকি দিয়েকিছু একটা বলতে ছিল কিন্তু আমি যেন কিছুই শুনতে পারছিনা।আমার চারিদিকে ঝনঝন করেপ্রচুর স্বর্ণমুদ্রাঝরে পড়তে লাগলো বাড়ির সেই উঁচু ছাদ থেকে। মনের মধ্যে প্রচন্ড বাসনা হচ্ছিল যেছুটে দৌড়ে চলে যায় সব স্বর্ণমুদ্রা যেন আমার ,সব তরুণী যেন একমাত্রআমার। কি যেসব বাসনারমায়াজাল জুড়ে গেল মুখে বলে বুঝাবার মত নয়। পরদিন সকালে বেলালের কাছে শুনেছিলামআমি নাকি হাসতে হাসতে অজ্ঞান হয়ে যায়।ভোরেই মোহিনী বাড়ি চলে যায়।সকালেদুজন বসে কথা বলছি এমন সময় দরজায় একটা আওয়াজ। গলাটা অতিপরিচিত মোহন এসেছে দরজা খুলে একটু বিস্মিত হই। তার সাথে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা চুল, হালকা উষ্কখুষ্ক চেহারা, বেশ কয়েকদিন পরিষ্কার না করা পোশাক। মুখমন্ডলে কোন শ্রী নেই, তবে মানুষটা চেনা। একটা প্রচন্ড হাসি দিয়ে-বন্ধু আমি এসে গেছি। সে আর কেউ নয় ব্রিজ লাল। তাকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করালাম কিন্তু পেছনে মোহনার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চেহারায় কেমন জানি একটি কিন্তু-কিন্তু ভাব। কি হয়েছে?- এ প্রশ্ন করায় সে উত্তরে বলল-গতরাতে দুধের গাভী টা মারা গেছে।গরু গুলো কিছু খাচ্ছে না ,ওদের জন্য ভালো চার আনতে আমি আগামীকাল পাশের গায় যাব। একথা বলেছে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।
খানিকটা সময় তিন বন্ধু মিলেজুটিয়ে এক আড্ডা দিলাম তার কিছু পরেই ব্রিজ লাল কে সব খুলে বললাম অবশ্য তখন সেখানে বেলাল উপস্থিত ছিল না সব শুনে ব্রিজ লাল বলতে শুরু করল
-বংশ-পরম্পরায় আমার নানা পন্ডিত তার সুবাদে বিভিন্ন রকম শাস্ত্র আমাদের আয়ত্তে আছে। ঘরে প্রবেশ করেইআমার নাকে প্রচন্ড রকমের একটা সুবাস আসে। এটা কোন সাধারন সুবাস নয়, খুব উচ্চ বংশের কোন অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ের পূর্বে মারা গেলে তার গোসলের পানিতে এই সুবাসমেশানো হত।
সে চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করল-এখানে এমন সত্তার অস্তিত্ব আছে যাকে শুধু তুমি অনুভব করতে পারবে তারা তোমাকে এবাড়ীতে বাঁধতে চায় তোমার মনের মধ্যে যখন যে রকমের বাসনা সৃষ্টি হবে, তার অনুযায়ী তারা পরিবর্তন হয়ে যাবে, তোমাদের সামনে যে মেয়েটি এসেছিল সে বেলালের কল্পনা থেকে সৃষ্টি।এইজন্যই বেলাল তার চেহারার বর্ণনা দিতে পেরেছিল। তোমার চিন্তা ভাবনা দিনের প্রতিটা কাজকর্ম তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়। আমি দীক্ষা অর্জন করেছি তাই তাদের মোহ আমাকে আকৃষ্ট করতে পারছে না ঘরে প্রবেশের সময় আমি তোমার চারিদিকেএকটা ভালো শক্তির স্তর তৈরি করে দিয়েছি, এইজন্য তুমি এখন স্থির। এই বাড়িতে প্রচন্ড সুবাস একাধিক তরুনীর শবদেহের অস্তিত্ব আছে বাড়িতে আজ রাতেই বাড়ি ছাড়তে হবে। পূর্ণিমা কেটেছে প্রথম চাঁদ আজকে। আমার শক্তি সকাল পর্যন্ত কাজ করবেনা।বেলালের শরীর কমে গিয়েছে ওর শরীর থেকে একটু একটু করে রক্ত নিয়ে নিচ্ছে তারা। দ্রুত কিছু করো তারা তোমাদের ছাড়তে চাইবে না। আমি ঘরে প্রবেশ করেই বেলালের চোখের চঞ্চলতা বুঝতে পেরেছি।সে তাদের আয়ত্তে।
সেই রাতেই বেলালকে জোর করে বেঁধে নিয়ে আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি পরে অবশ্য মোহনের কাছে জানতে পেরেছিলাম প্রতি তিন মাস অন্তর একটি করে গাভী মারা যেত।পরবর্তীতে পাশের গ্রামে সেই বাড়ির যেই ইতিহাস শুনেছিলাম তা ছিলকল্পনার থেকেও করুন।
ভদ্রলোক সেই বাড়ির কথাশুরু করবেন এমন সময়কানে একটা ঢাক আসলো-পেনশন ফাইল নাম্বার633হাজির হন।তারপরে দাদুর পেনশন নিয়ে এসে লোকটিকে আর দেখতে পাইনি
(শেষ)
মোঃ মমিনুল হাসান সাওন