“ফাইল নাম্বার ৬৩৩”

মহাম্মাদ শাওন/পর্ব চার

সেই বিকেলটায় একটা আরামকেদারা নিয়ে বাড়ির পিছন বারান্দায় বসে তনময় হয়ে নদীর পানির নিত্য দেখছি। ওপারের বনে যে ঝাকে ঝাকে পাখি বাড়ি ফিরছে তা দেখে মনটা যেন স্থির হয়ে গেল। প্রচণ্ড তাপদাহের দিনে নদী ছোঁয়া হিমেল বাতাস যেন শরীরের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এক অলসতা জুড়ে দিচ্ছে। চোখটা যেন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। ধুপকরে মনের মধ্যে চাঞ্চল্যতা ফিরল কিছু হাসির শব্দে। কার হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে আর কোথা থেকেই বাতা আসছে। হ্যাঁ এটাতো ঘরের ভেতর থেকে আসছে একটানা অনেকগুলো হাসি। না অনেকগুলো অল্প বয়সী মেয়ে মানুষের হাসি। কিন্তু কেন হাসছে তারা হাসির শব্দ যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর কিছু পরেই তার সাথে জুড়ে গেল আরও একটা হাসি, প্রচন্ড অট্টহাসি। না একজন পুরুষের বেগবান হাসি। আমার শরীর যেন ভার হয়ে আসছে ওই যে বিয়ে বাড়িতে যেমন হয় সবার কথার মাঝখানে যেমন জাগনা ঘুম হয় ঠিক সেই রকমই কিছু একটা অভিজ্ঞতা। এইসব কিছু শুনতে শুনতে দরজা খোলার শব্দে পুরো নাটক এর উপর পর্দা পড়ে গেল। আর কানে ভেসে আসলো বেলালের পরিচিত গলা.- তুই একা একা বসে কি করছিস। শুনলাম পাশের গ্রামে নাকি মেলা লেগেছে। সব কাজ তো মোহন করে চল কাল দিনের বেলা একবার মেলাটা ঘুরে আসি। ঐদিন রাতে বেলালকে কথাগুলো বলতে চেয়েও যেন বললাম না বোধ করি মোহনের মুখে ওই ধরনের কথা শুনে হয়তোবা আমার মন নিজে থেকেই খেয়ালী পোলাও পাকিয়ে নিয়েছে গত রাতেই তো দিব্যি সেখানে ঘুমিয়ে থাকলাম আর এত সুন্দর বাড়ি বেজায় রাজার হালে আছি।তাই অযথা বেলালকে বলে ভয় পাইয়ে কোন লাভ নেই।এমনিতেই সে ভীত।এই ভেবেই আমি চুপ মেরে গেলাম।
পরদিন সকাল বেলা খেয়ে আমরা বের হলাম পাশে গ্রামের মেলার জন্য। মধ্যাহ্নভোজের আগে আগেই ফিরে আসলাম বাড়ি। মোহনকে বলে গিয়েছিলাম তাই সে ভাত রান্না করে রেখেছে বেলাল ভালো রান্না করতে পারে তাই সে তরকারি বসিয়ে দিল। আসার সময় ব্রিজ লালের ঠিকানায় আমাদের ঠিকানাটা জানিয়ে একটা চিঠি দিয়ে এসেছি সপ্তাহখানেক এর জন্য আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে সেই চিঠি খানায়।
এভাবে সপ্তাহখানেক বেশ আরামে কেটে গেল। তেমন কোন কাজ নেই শুধু একটু দেখাশোনা করা আর দিব্যি খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি। ২-৩ দিন পরপরই জমিদার বাড়ি থেকে চাল ডাল তেল সবকিছুই দিয়ে যায় হাত খরচের কিছু উপরি পয়সাও দিয়ে যায় তারা কি আর লাগে বেশ আরামের সময় যাচ্ছে। শুধু সমস্যা একটাই এ তল্লাটে এ বাড়ির যে পরিমাণ কুখ্যাতি রয়েছে তাতে বাড়ির কাজের জন্য কোন মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির সামনের ছোট বারান্দায় বসে এসব কিছু ভাবছি তখনই একটা অল্প বয়সী মেয়ের গলার স্বর কানে আসলো. এমন ভারী মিষ্টি গলার স্বর আমি জীবনেও কখনো শুনিনি যেন তার কথা বলার সময় চারিদিকে বিনার সুর বেজে ওঠে সপ্তসুরের এমন আশ্চর্য মিল গলার স্বরে এর আগে কখনো শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়নি মাথা তুলে দেখিমুহুর্তের মধ্যে বেলাল আমার পাশ থেকে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়েছে মাথা পর্যন্ত ঘোমটা নামানো এক অল্প বয়সী মেয়ে।
কি প্রয়োজন? – এই প্রশ্ন করার পর মুহুর্তেই তার বিনার সুর যেন বেজে উঠলো
কথার মধ্যে একটু আকুতি মিশ্রিত করে বলল-সাহেব আমাকে কাজে নেবেন? আমি সব পারি আমি জানতে পেরেছি আপনারা নাকি কাজের লোক খুঁজছেন।আমাকে যদি…
-আচ্ছা তা তো বুঝলাম কিন্তু তুমি একটা মেয়ে লোক আমরা দুজন পুরুষ থাকি বাড়িতে আমি কাজের জন্য কোন পুরুষ লোককে খুজছিলাম যে আর কি টুকটাক কাজ করে দিতে পারে। তোমাকে যদি আমরা কাছে রাখিও তবে তোমার পরিবারের লোকজন….আচ্ছা, তাদের কথায় না হয় বাদ দিলাম কিন্তু গ্রামের লোক কি এটাকে ভালোভাবে নেবে খামাখা বদনামের ভাগিদার হবে কেন।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে স্থির দাবা দাবা স্বরে বলতে শুরু করল সে-আমার পরিবারের সমস্যা নেই সাহেব আর বাকি রইলো গ্রামের লোকের কথা তাদের কাছে সময় নেই আমাদের কথা ভাবার মতো আমরা যে অন্য জাত আমরা যে একা তাই ওদের আমাদের নিয়ে ভাবার কিছু নেই।
আমি খানিকক্ষণ সময় চিন্তা করার চেষ্টা করছিলাম তারই মধ্যে বেলাল তাকে হ্যাঁ বলে দিলো -আচ্ছা কাল থেকে তুমি কাজে আসো।
-সাহেব আমার একটা কথা রাখা যাবে, আমি যখন রান্না করব আপনারা বাড়িতে কেউ থাকবেন না এবং গ্রামবাসীকে বলিয়েন না যে আমি এখানে কাজ করছি জানি তারা আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করেনা কিন্তু তবুও একটা ভয় তো থাকে সাহেব আমরা অন্য জাত গ্রামবাসী হয়তোবা আমার কাজ করাটাকে ভালোভাবে নেবে না তাই যদি সাহেব আপনি কথাটা..-বলে সে থেমে গেল আমি কিছু বলার আগেই বেলাল সবকিছু ঠিক করে ফেলল। বেলালের এই ধরনের উৎসুক মনোভাব আমি খুব কমই দেখেছি।
অন্যমনস্ক ভাবটা কাটিয়ে বললাম-তুমি এ-বাড়ির সম্পর্কে কিছু শোনোনি তোমার কি ভয় লাগে না?
দৃঢ় কণ্ঠে বলল-আমি ভয় পাইনা সাহেব।
এমনিতেই বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া একটু কষ্টকর হচ্ছেএমন অবস্থায় একে বাদ দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না এটা ভেবেই আমিও বেলালের কথায় কোনো বাঁধা দিলাম না।

সেই রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাহিরে প্রকৃতির পুরো দৃশ্যটা যেন মনমুগ্ধকর ফুটফুটে পূর্ণচাঁদের জোসনার আলো নদীর টলটলে জলে যেন মতির মত জ্বলছে যেন একতাল মুক্ত.. আকাশের চাঁদটা যেন একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ঘুম আসছে না তো কি হয়েছে এইরকম মনমুগ্ধকর প্রকৃতির উপভোগ তো আর সব সময় করা যায় না এই চিন্তা করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে কেমন একটা গুমোট ভাব অনুভব হলো এমন একটা অনুভূতি যেন আমার পাশ থেকে দাঁড়িয়ে আমাকে কেউ দেখছে যেন আমরা দুজনে ছাড়া আরো কারো অস্তিত্ব আছে ঘরে। বাইরে ঝিঝির গানের সাথে আর একটা শব্দ ভেসে আসছে কানে, যেন কেউ পায়ে নূপুর পড়ে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ করে আমাকে ডাকছে মুহুর্তের মধ্যেই পৃথিবীর সবকিছু যেন আমি ভুলে গেলাম আমি কে ,আমি কেন এখানে এসেছ, আমার বন্ধু বেলাল সে যে আমার পাশেই আছে তাকে যে আমি একবার ডাক দেবো সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছ, শুধু মনের মধ্যে একটাই কথা আমাকে ডাকছে, আমিতো চিৎকার করে তাকে বলতে চাই এইতো আমি আসছি কিন্তু মুখ ফুটে একটা স্বর বের হচ্ছেনা। সেই মন্ত্রমুগ্ধ কর সংগীতের প্রতি আমি যেন তনময় হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম দুপা চলে থেমে গেলাম,

পরবর্তী পর্ব পড়তে চোখ রাখুন  foxnewsbd.com ও ফক্সনিউজ বিডি ফেসবুক পেজে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে