

নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা শেখ মোহাম্মদ শফিক। ২০০৫ সালে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এসএসসির পর বন্ধ হয়ে যায় তার পড়ালেখা।
বর্তমানে তার বয়স ৩৮ বছর। রয়েছে দুই কন্যা সন্তানও।
তবুও হাল ছাড়েননি। পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষে।
শফিক জানান, ২০০৪ সালে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার সোনাতলা পাইলট হাইস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে এইচএসসির জন্য ভর্তি হন বগুড়ার শাহ্ সুলতান কলেজে। কলেজে ক্লাস শুরু হয় ২০০৫ সালে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মেস ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। পড়ালেখার তাগিদ দেয়ার মতো কোনো অভিভাবক না থাকায় আর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতার আশায় বাড়িতে গিয়ে এলাকার তিন বন্ধু মিলে চালু করেন কোচিং সেন্টার। কোচিংয়ের নাম দেন ক্যাপিটাল। পড়ালেখা বেশিদূর পর্যন্ত না করায় এলাকার মানুষের নানা বিদ্রুপ ও সমালচনামূলক কথায় বাধ্য হয়ে বন্ধ করেন কোচিং সেন্টারটি।
শফিক বলেন, ‘কোচিং সেন্টার বন্ধের কয়েক বছর পর ২০০৮ সালে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। বিয়ের ১৭ মাস পরেই বিচ্ছেদ হয়। এ কারণে আরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।
‘বন্ধুরা আমার অবস্থা দেখে বললেন তোর মেধাশক্তি অনেক ভালো। অন্তত ইন্টারমেডিয়েটটা পাশ কর। পরে ২০১১ সালে এলাকার এক বন্ধু (লিটন) আমাকে জোর করে কারিগরিতে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি করে দেয়। পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ানো শুরু করলাম। ২০১৩ সালে ৪.৪২ জিপিএ নিয়ে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করলাম। সেখান থেকে ডিগ্রিতে ভর্তি হতে গেলাম বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে।’
তিনি বলেন, ‘এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার পাশের বছরের পার্থক্যের কারণে ডিগ্রিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি নিলেন না। তাই আর ডিগ্রিতে ভর্তি না হয়ে শুধু প্রাইভেট পড়াতেই থাকলাম। মোটামুটি ভালোই চলছিল। তাই ২০১৩ সালে আবার বিয়ে করি। এখন আমার দুটা মেয়ে আছে। বড় মেয়ের বয়স ৮ বছর এবং ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর।’
শফিক বলেন, ‘যেহেতু ৬ থেকে ১০ ক্লাস পর্যন্ত প্রাইভেট পড়াতাম। তাই এই ক্লাসের সাবজেক্টগুলোর ওপর ভালো দখল চলে আসে। এলাকার পরিচিত ভাইরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা ও বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন আমার কাছে থেকে সমাধান করে নিতো। দেখা যেত ওই প্রশ্নগুলো ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই পারতাম। এগুলো দেখে তারা বলত, ভাই আপনার যে মেধা আছে আপনি বিসিএস ক্যাডার হতে পারবেন। আপনি আবার পড়তে পারেন।
‘পাশাপাশি এলাকার আরেকটা ভাই (মোনারুল ইসলাম) যিনি ২০০১ এ একবার এসএসসি পাশ করেন এবং পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। পরে আবার ২০০৯ সালে তিনি ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেন। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হলাম এবং তাকে অনুসরণ করে ২০১৬ সালে আবার এসএসসিতে কারিগরিতে ভর্তি হই। সেখানে ৪.৬৮ রেজাল্ট নিয়ে ২০১৮ সালে পাশ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশায় জেনারেল লাইনে ড. এনামুল হক কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে ২০২০ সালে ৪.৮৩ জিপিএ নিয়ে পাশ করি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে শফিক বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন এলাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাই। তার নাম নূর নবী। তিনি এখন বিসিএস ননক্যাডার থেকে একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। একদিন তিনি বলেন, জেনারেল লাইনে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন। কারণ জেনারেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সহজ। তাই কারিগরিতে এসএসসি দেয়ার পর জেনারেলে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হইনি। বাড়িতে একাই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ২০২১ সালে পরীক্ষা দেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিজ্ঞতা না থাকায় লিখিত পরীক্ষায় ০.৫ নম্বরের জন্য পাশ করতে পারিনি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা হারিয়ে যায়। আমার এক ছাত্র বলেছিল, স্যার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেন অন্তত অভিজ্ঞতা হবে। তাই সে বছরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সিরিয়াল এল ২৬১তম।’
সংসার চালানোর ব্যয়ভারের বিষয়ে শফিক বলেন, ‘বাসায় থাকতে প্রাইভেট পড়াতাম। মাসে প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা ইনকাম হতো। ওই টাকা দিয়েই সংসার চালাতাম। এখনো এভাবেই চালাচ্ছি। তবে আগের মতো টাকা ইনকাম করতে পারছি না। নিজে চলছি আর কিছু টাকা বাড়িতে পাঠাচ্ছি।’
শফিকের শিক্ষার আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত হবে। আর একজন মানুষকে জ্ঞানি হতে হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে। আমার দৃষ্টিতে শুধু এসএসসি পর্যন্ত পড়লেই তাকে একজন শিক্ষিত বলা যায় না। কারণ তারা তখনো ছোট থাকে। যারা ইন্টারমেডিয়েট পাশ করেছে তারা উচ্চশিক্ষার শিঁড়ি পর্যন্ত গেছে। তাদের শিক্ষিত বলা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয় দুটা জিনিস যদি কেউ রাখতে পারে সে সফল হবেই। এর মধ্যে একটি হলো ইচ্ছাশক্তি এবং আরেকটি পরিশ্রম। সেটা যেকোনো ক্ষেত্রে হতে পারে। এই দুটো জিনিস তার মধ্যে থাকলে সে সফলতা অর্জন করবেই। আমি এই দুটা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই এতদূর এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী যদি পড়াশোনা করতে চায়, অবশ্যই সে যেন বেসিকের সাথে করে। কারণ এটা ছাড়া সে সফল হতে পারবে না। আর কোনো কিছু আন্দাজে মুখস্ত করা যাবে না। বুঝে মুখস্ত করতে হবে।’
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ছাত্র বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে মানুষকে শেখানোর একটি বিশেষ গুন দিয়েছে। এখানে আমার বয়স একটি বড় বাধা। আমি চাইলেও এখন আর বিসিএস ক্যাডার কিংবা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারব না। তবে আমি উচ্চশিক্ষা অর্জন করবই। ভবিষ্যতে একটি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ আমি প্রতিষ্ঠা করব। এটা আমার স্বপ্ন। যেখানে শিক্ষার্থীদের আমি বেসিক শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তুলব। ওদের মধ্যে কেউ যদি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হয় তাহলে আমি মনে করব আমি সেটা অর্জন করেছি। ওদের মাঝেই আমি আছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উচিত যে বিষয়ে আমরা পড়াশোনা করছি ভবিষ্যতে সেই সেক্টরেই কাজ করা। তা না হলে এক সেক্টরে পড়ে গিয়ে আরেক সেক্টরে চাকরি করবে এটা হয় না। এটা এক ধরনের বৈষম্য।’