আজিজুর রহমান, সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি:
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ কৃষক আর দিনমুজুর। এসব গরীব মানুষেরা রোগে আক্রান্ত হলে তাদের একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতাল। তবে ভরসার সেই হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না সরকারি ওষুধ। চিকিৎসকরা রোগনির্ণয় করে অসহায় রোগীদের হাতে লিখে দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির দামি ওষুধের কাগজ। যা কিনে খাওয়ার সক্ষমতা অনেকের নেই। ফলে সরকারি ওষুধ না পেয়ে রোগা শরীর নিয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। এমন অবস্থা চলছে সালথা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
অভিযোগ রয়েছে- বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কাজী আব্দুল মমিন। তাই সরকারি ওষুধ ঊধাও করে দিয়ে রোগীদের বড় কোম্পানির ওষুধ লিখে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী ওষুধ লিখে দিচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করতে হাসপাতালে আসা ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের টানাহেঁচড়ায় অতিষ্ট হয়ে পড়ছেন রোগীরা। মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮ কোটি ৭০ লাখ ব্যয়ে ৫০ শয্যা এই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে করোনার সময় হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের করুণ দৃশ্য, রোগীদের আর্তনাদ ও নোংরা পরিবেশ। চিকিৎসকের রুম থেকে রোগীরা বের হলেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের হাতে থাকা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাটানি করছে ও ছবি তুলছে। যদিও সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষেধ। তারপরেও বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত হাসপাতালের গেটে রোগীদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে দেখা যায়, যেখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে হাসপাতাল ভবনের দেয়ালের টাইলস। নতুন বেডগুলো (যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি) ধুলো-ময়লায় ডেকে গেছে। টয়লেটগুলো ব্যবহারে অনপযোগী হয়ে আছে। অনেক জায়গায় ময়লা-আবর্জনা জমে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। ওয়াশরুমের বেসিনগুলো ভাঙ্গাচুরা। সব মিলিয়ে যেন ভুতরে পরিবেশ চলছে চিকিৎসাসেবা। দেখে বোঝার উপায় নেই হাসপাতালটি মাত্র কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ইনচার্জ সুমিত্র মন্ডল বলেন, জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ এমন হয়েছে। সুইপার না থাকায় টয়লেট নোংরা। আর টাইলসগুলো খুলে পড়ছে হাসপাতাল নির্মাণ করার পর থেকেই। ভবনের কাজ মানসম্পন্ন না হওয়ায় টাইলস খুলে পড়ছে বলে মনে করি।
নাসিমা আক্তার নামে এক ভ্যান চালকের স্ত্রী বলেন, টাকার অভাবে শিশু বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকে হাসপাতালে এসেছি সরকারি চিকিৎসা ও ওষুধ নিতে। কিন্তু চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিয়েছে, সরকারি কোনো ওষুধ দেয়নি। সরকারি ফ্রি ওষুধ নেই বলে জানিয়েছে। কিন্তু যে ওষুধ লিখে দিয়েছে তা কেনার মতো টাকা আমার কাছে নেই।
চান মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিয়েছে। একটা সরকারি ওষুধও দেয়নি। আমি এসেছিলাম, ডা. দেখিয়ে ফ্রি ওষুধ নিতে। কিন্তু পেলাম না, তাই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি।
সুত্র সেন নামে আরেক রোগী বলেন, আমার স্বাশ্বকষ্টে সমস্যা। অথচ চিকিৎসক একপাতা প্যারাছিটামল দিয়েছে আর কোনো ওষুধ দেয়নি। সব ওষুধ লিখে দিয়েছে। বাইরে দোকান থেকে কিনে খেতে বলেছে। বাইরে বের হওয়ার সময় একদল লোক আমার ওষুধের কাগজ হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছবি তোলে রেখেছে।
হাসপাতালের সামনে অবস্থানরত রাজু নামে একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধি বলেন, আমরা কারো কাছ থেকে জোর করে ছবি তোলা হয় না। হাসপাতাল থেকে বের হলে রোগীদের অনুরোধ করে ছবি তুলি। এটা আমাদের কোম্পানি দায়িত্ব দিয়েছে, কি করবো বলেন।
হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে চুক্তিবদ্ধর বিষয়টি জানা চাইলে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিরা বলেন, কোম্পানির সাথে হাসপাতালের কারো চুক্তি হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু আমাদের দায়িত্ব পালন করছি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কাজী আব্দুল মমিন বলেন, নতুন হাসপাতাল, তাই ওষুধের বাজেট কম। তবে ওষুধ সরবারহ করছি না বা ওষুধ না পেয়ে রোগীরা ক্ষুব্দ হয়ে ফিরে যাচ্ছে, এই তথ্যটা আমার কাছে নেই। কমন আইটেম ওষুধ সব সময় দিতে পারি। কিছু আনকমন আইটেম ওষুধ দিতে পারি না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, কোনো ওষুধ কোম্পানির সাথে সম্পর্ক নেই। কিছু ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিরা বাইরে এসে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলে। আজকেও আমি কয়েকজন ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিকে বের করে দিয়েছি। এরপরেও ওরা আসে, যা আমি অনেক সময় জানিও না।
নোংরা পরিবেশ সম্পর্কে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতাল চালু হওয়ার পর থেকে নীচতলার দুটি বাথরুমে পানির লাইন বন্ধ রয়েছে। তারপর সুইপার ও পরিছন্নতাকর্মীর পদে কোনো লোক নেই। যে কারণে পরিবেশ একটু নোংরা। আর ভবন নির্মাণের পর থেকেই টাইলসগুলো খুলে পড়ছে। বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সালথা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, সরকারি ওষুধ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের কোম্পানির ওষুধ লিখে দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে সব সময় সব ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোম্পানি প্রতিনিধিরা যাতে হাসপাতালে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালে যে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সে বিষয় আমরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।