নূরে ইসলাম মিলনঃ ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন দেশের সাংবাদিকরা, তথা পুরো গণমাধ্যম। সমালোচনার তিরবিদ্ধ করছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত এই খাতকে। যে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, তাদের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে প্রতিনয়িত। যে গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় ও অনিয়ম অনুসন্ধান করে বের করে আনেন, তাদের কর্মকাণ্ডই এখন প্রশ্নের মুখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে মনে হবে, রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষই বুঝি এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। আসলে কি তাই? সাংবাদিকরা কি সবার প্রতিপক্ষ? উত্তর সহজ,আমরা সাংবাদিকেরা কারো প্রতিপক্ষ নই। যারা নিজেদের করে যাওয়া অন্যায় গুলো আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ, একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করে, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ, একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না।
পুলিশ বা অন্য যেকোনো পেশার অসৎ লোকেরা একজন সৎ সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না বা তোয়াজ করে না। ফলে সুযোগ পেলেই তারা সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়। ক্ষমতাবানরা জানে, তাদের অন্যায় কাজগুলো দেশের মানুষ শুধু এই সাংবাদিকদের কারণেই জানতে পারে। না হলে দেশ বহু আগেই লুটপাট করে খেয়ে ফেলত তারা। কিন্তু যেহেতু তারা এই অবাধ লুটপাট করতে পারে না শুধু গণমাধ্যমের ভয়ে, তাই গণমাধ্যমই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ, শত্রু।।
আমদের সাংবাদিকরা একদিকে নানা গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষ, অন্যদিকে বিবদমান গোষ্ঠীর ক্রসফায়ারেও পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে সাংবাদিকরা সব অন্যায়ের বিচারের কথা লেখেন, সেই সাংবাদিকদের নিহত হওয়া বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও তাদের পাশে কেউ থাকে না। বরং সুযোগ পেলেই গালাগালি আর বিষোদ্গারের ডালি খুলে বসে। যে সাংবাদিকরা পোশাক ও পরিবহন শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষের বেতন বৈষম্য ও মানবাধিকারের কথা লেখেন, প্রচার করেন, সেই সাংবাদিকদের নিজেদের বেতনের দাবিতেই রাজপথে দাঁড়াতে হয়। তাদের পাশে অন্য পেশার মানুষ এসে দাঁড়ায় না। যার সবশেষ উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ। নিয়মিত বিরতিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সবশেষ মাসের বেতনও অনেকে পান না। কিন্তু এসব বঞ্চনার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়।
আমরা সবাই জানি, এককালে স্বাধীন সাংবাদিকতার মূল প্রতিপক্ষ ছিল রাষ্ট্র। বেশিরভাগ রাষ্ট্রশক্তি বা শাসকগোষ্ঠী তাদের সমালোচনা, অপকর্ম, দুর্নীতি বা অপশাসন উদঘাটন কিংবা অগণতান্ত্রিক বা অমানবিক কর্মকাণ্ডগুলোর প্রচার সইবার মানসিকতা রাখে না। কাজেই স্বাধীন সাংবাদিকতা তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে পরিগণিত হবে, এটিই স্বাভাবিক। আমরা যদি কেবল দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলোর সাংবাদিকতার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করি, দেখতে পাই, অনেক রাষ্ট্রই নিবর্তনমূলক আইন প্রবর্তন করেছে, নির্যাতনমূলক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কিছু রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি বা মূলনীতি বিবেচনা করায় গণমাধ্যমের স্বাধীন বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সুখের বিষয়, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সিভিল সোসাইটির বিকাশ, তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রা এবং প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মুক্তবুদ্ধিবৃত্তি ও তার মনোজাগতিক বিকাশ-এ প্রবণতার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ বা মুক্ত তথ্যপ্রবাহ থেকে মানুষকে আর বঞ্চিত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তথ্য লাভের অধিকার আজ মানুষের স্বীকৃত ব্যক্তিক, সামাজিক ও নাগরিক অধিকার-যুগের দাবি। এরপরও বলতে হবে যুগের বিবর্তনে রাষ্ট্রশক্তিই স্বাধীন সাংবাদিকতার একমাত্র প্রতিপক্ষ থাকেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুবিধ নতুন প্রতিপক্ষ, যারা শক্তিধর এবং কার্যকরভাবে মুক্ত-স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করার ক্ষমতা রাখে, নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধে আবদ্ধ করে। এসব প্রতিপক্ষ কখনো অগণতান্ত্রিক শাসক, কখনো ক্ষমতার অবৈধ দখলদার, কখনো প্রতাবশালী করপোরেট পুঁজি বা ‘বিগ বিসনেস’, কখনো সুসংঘবদ্ধ চোরাচালানিচক্র, কখনো উগ্রধর্ম বা অসহিষ্ণু আদর্শবাদী গোষ্ঠী আবার কখনো উগ্রবাণিজ্যবাদী, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন বা মালিক-সম্পাদকের দুর্ভাগ্যজনক বিকাশও বস্তুনিষ্ঠ বা বলিষ্ঠ সাংবাদিকতার এক নতুন প্রতিবন্ধকতা।
আমার জানা মতে পৃথিবীর আর কোনো পেশার মানুষকে এতগুলো পক্ষের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় না। অথচ এই পক্ষগুলোই গণমাধ্যমের মূল অংশীজন বা স্টেকহোল্ডার। কিন্তু অনেক সময়ই এসব অংশীজন প্রতিপক্ষে পরিণত হয় এবং গণমাধ্যমকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। তার ওপর সাংবাদিকদের বিরাট অংশেরই চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পেশাদারত্ব গড়ে ওঠেনি। সুতরাং, এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় যে গোষ্ঠীকে, তাদের কাছ থেকে সব সময় নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করা কতটুকু সমীচীন-তাও ভেবে দেখা দরকার।
এত সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যম সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই পরিবেশন করবে, মানুষের এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু গণমাধ্যম সব সময় সেটি পারে না। আবার সব সংবাদেরই যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষ আছে, ফলে একটি খবর যখন কারও পক্ষে যায়, সেটি কারও বিপক্ষেও যেতে পারে। যখনই কারও বিপক্ষে যায়, তখনই তিনি গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিও মুহূর্তেই গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবা শুরু করতে পারেন, যদি তার স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ পরিবেশিত হয়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করবেন না যে, এই সীমিত স্বাধীনতা ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমই দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কারণ চারপাশে এত বেশি খারাপ লোকের আধিপত্য যে, তারা কেবল ক্যামেরাগুলোকেই ভয় পায়। না হলে বহু আগেই সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে যেত। যেহেতু সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে হজম করার পথে প্রধান অন্তরায় গণমাধ্যম, অতএব তারাই শত্রু, তারাই প্রতিপক্ষ।
লেখক: সাংবাদিক
মো: নুরে ইসলাম মিলন।
সভাপতি
জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা
রাজশাহী বিভাগ।