পরিমল কুমার পরাণঃ ‘হিজড়া’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। যাদের জন্ম মাতৃগর্ভে। কিন্তু তারা পুরুষও নয়, নারীও নয়। মানুষ হয়েও তারা পায়না মানুষের মর্যাদা। তারা বঞ্চিত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সব অধিকার থেকে। তাদের জন্য নেই কোন কাজের ব্যবস্থা। জীবনের তাগিদে এ সম্প্রদায়ের মানুষ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কাজে। অথচ তাদের দিকে যেন তাকানোর সময় নেই কারও।

রাজধানীসহ সারাদেশে বাস করছে কয়েক হাজার হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা একত্রে, কখনও বা ছোট-ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বাস করছে। প্রতিটি দল নিয়ন্ত্রণ করে এক বা একাধিক নেতা, যাদের ‘গুরুমা’ ও ‘সরদারনি’ বলে ডাকা হয়। সাধারণত এ সব সরদারনি সাধারণ হিজড়াদের দিয়ে একেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

কিন্তু এই বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসে মানবেতর জীবন-যাপন করছে এই হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষরা। হিজড়া সরদারনিদের তথ্য মতে, রাজধানীর শ্যামপুর ও কদমতলী থানায় বসবাস করে প্রায় ২ শত হিজড়া। এবং এর আশেপাশের কিছু এলাকা নিয়ে বসবাস করে প্রায় ৪ শত হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা ৯ টি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় বসবাস ও নিয়ন্ত্রণ করছে। ৯ টি ইউনিটে রয়েছে ৯ টি সরদারনি। আলমবাগ ইউনিটের সরদারনি সিমলা ৬ সদস্য নিয়ে বসবাস করেন জুরাইন আলমবাগে। সিমলা জানান, আমরা না পারি কাউকে বলতে না পারি সইতে। এই লকডাউনে আমাদের আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় খুবই কষ্টে আছি।

কদমতলীর দনিয়া ও রসুলবাগ ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করে সরদারনি ফুলকলি। ছোট্ট একটি ঘরে ৯ জন নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করেন তিনি। এখানকার গুরুমা ফুলকলি জানায়, লকডাউনের আগে আমরা ভালোই ছিলাম। কিন্তু এই কঠোর লকডাউনে আমরা কারো বাসা বাড়িতে যেতে পারিনা। দোকান-পাট বন্ধ থাকায় সেখান থেকে সাপ্তাহিক টাকা নিতে পারিনা। ফলে আমাদের আয় সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের টিকে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ছে। বাসাভাড়াও দিতে পারিনা বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।

কদমতলী থানার শ্যামপুর বরইতলার একটি বাসায় প্রায় ৪০ জন হিজড়া বসবাস করেন। এ ব্যাপারে হিজড়াদের সংগঠণ ‘সুস্থ্যজীবন’ এর নির্বাহী পরিচালক ও সরদারনি ববি এবং শ্যামপুর কদমতলী থানার সরদারনি পপি জানান, আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় এই লকডাউনে আমাদের সদস্যরা খুবই কষ্টে আছে। দোকান-পাট থেকে সাপ্তাহিক টাকা আদায় বন্ধ ও বাসা-বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ থাকায় নবজাতক শিশু, বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদসহ সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা পড়েছি চরম বেকায়দায়। গতবছর প্রথম লকডাউনে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা পেলেও এবার এখনো কেউ আমাদের খোঁজ-খবর নেয়নি, দেয়নি কোন ত্রাণও। আমরা তো ইচ্ছা থাকলেও অন্যান্য কাজে যেতে পারিনা ও আমাদের কাজেও নেয়না। আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে বলে দুঃখ প্রকাশ করে তারা । সরকারের কাছে হিজড়া সম্প্রদায়ে মানুষের জন্য ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তার জন্য অনুরোধ করেন গুরুমা’রা।

উল্লেখ্য হিজড়ারা একত্রে মিলে বাজারে-বাজারে নাচ-গান করে তরি-তরকারিসহ কিছু টাকা সাহায্য তুলে পাশাপাশি খতনা, বিয়ে,গায়েহলুদ তথা নবজাতক শিশুকে দোয়া-আশির্বাদ দিয়ে বকশিস নিয়ে থাকেন। এগুলোই তাদের আয়ের মাধ্যম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে