নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতাল নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালের মেডিকেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টাকা পেলেই সুস্থ হাজতিদের হাসপাতালে বেড দিয়ে দেয়।
হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি রাজশাহী জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভার গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরেন আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও রাজশাহী প্রেসক্লাবের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক সাইদুর রহমান। সভায় তিনি বলেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে সুস্থ হাজতিদের জন্য কর্তব্যরত ডাক্তার মনে করলেই বন্দীদের হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন। অসুস্থ হাজতিদের চিকিৎসার জন্য এখানে ২০০ শয্যার হাসপাতাল থাকলেও অধিকাংশ বন্দী টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে থাকার সুযোগ পায়। এজন্য তাদের মাসে গুণতে হয় সাড়ে ৫ হাজার টাকা। সাইদুর রহমান এব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করেন এই সভায়। সভার সভাপতি রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ^স্ত করেন। এরপরও হাসপাতালে বন্দীদের বেড বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতি দূর হয়নি।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের মেডিকেল চীফ রাইটার তাসবির রহমান ও মেডিকেল রাইটার সোহেল বিভিন্ন ঘুমের ঔষধসহ গাঁজা বিক্রির পাশাপাশি নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের মেডিকেল রাইটার সোহেল ও চীফ রাইটার তাসবির রহমান প্রত্যক্ষভাবে এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে যুক্ত। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালে দুর্নীতি-অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করলেই মেলে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা। কারা কর্তৃপক্ষ এ অনিয়ম নিরসনে কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় মেডিকেল রাইটার ও ডাক্তারদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। মেডিকেল রাইটাররা টাকা পেলেই বন্দীদেরকে সুবিধা দিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মোঃ কাওসার আলী জানান, কোন হাজতি কারাগারের চিকিৎসক জুবায়েরকে ৫,৫০০ থেকে ৬,০০০ টাকা পরিশোধ করলেই কারা হাসপাতালে একমাসের জন্য সহজেই বেড পেয়ে যান। আর এই টাকার ভাগাভাগি করার দায়িত্বে রয়েছেন কারাগারের টেকনোলজিস্ট মাসুদ। কাওসার আলী জানান, হাসপাতালের বেড পেতে হলে অসুস্থ হওয়া জরুরী নয়। কোন নিয়ম ও বিধি অনুসরনেরও প্রয়োজন নেই। টাকা দিলেই হাজতিদের দিয়ে দেয়া হয় বেড। আর অসুস্থ হাজতিরা কম্বল বিছিয়ে থাকেন মেঝেতে। কাওসার আলী অভিযোগ করেন, সোহেল ও তাসবির রহমান প্রতিদিনই রাত ৯ টার পর হাসপাতালের ৫নং কক্ষে বসান নেশার আসর। এব্যাপারে বন্দীরা প্রতিবাদ করলে তাদের উপরে চলে নির্যাতন। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের কোন ওয়ার্ডে কতজন থাকবে সব নিয়ন্ত্রণ করেন টেকনোলজিস্ট মাসুদ। সপ্তাহে ২দিন জেল সুপার হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। যখন তিনি ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন তখন বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে অচল-বৃদ্ধ ও অসুস্থ হাজতিদের এনে হাসপাতালের বেডে বসানো হয়। আর সুস্থ হাজতিদের বেড থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সাধারণ ওয়ার্ডে। তবে এসব অনিয়ম সম্পন্ন করতে সিনিয়র জেল সুপারের পরিদর্শনের আগেই কয়েদি ইনচার্জ (সিও ম্যাড), রাইটার, সেবক এবং ফার্মাসিষ্টরা অসুস্থ হাজতিদের কিছু কথা শিখিয়ে দেন- “আমি এ বেডেই থাকি, সমস্যা নেই, খাওয়া ও চিকিৎসা ভাল হচ্ছে।” এ প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র ১ ঘন্টার জন্য, কিছুক্ষণ পর আবার যা অবস্থা তাই রয়ে যায়। সোহেল ও তাসবিরের নামে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও কারা প্রশাসন রহস্যজনক কারনে কোন পদক্ষেপ নেয় না। কারন তারা ডাক্তার জুবায়েরকে মাদক ব্যবসার অর্থের ভাগ দিয়ে থাকেন। যে কারনে তাদের বিরুদ্ধে কেউ যদি সাহস করে মুখ খোলে, তাহলে তাদের উপর চলে নির্যাতন।
এ বিষয়ে আরেক ভুক্তভোগী মোঃ আপেল জানান, টাকার বিনিময়ে সুস্থ হাজতিদের কারা হাসপাতালের বেডে রাখে এবং অসুস্থ হাজতিদের মহানন্দা ১নং ওয়ার্ডে রাখা হয়। অসুস্থ হাজতিদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার নগদ অর্থের বিনিময়ে দেয়া হয়। অসুস্থ হাজতিদেরকে ভেজাল খাবার দেয়া হয়ে থাকে। দুধে পানি মেশানো হয়। পরিবারের নিকট থেকে প্রাপ্ত খাবার ইনচার্জ ও রাইটাররা অনেকটাই খেয়ে ফেলে, ছিটেফোটা খাবার হাজতিদের দিয়ে থাকে। এছাড়া অভিযোগের মধ্যে আরও রয়েছে- ক্যান্টিনে দ্রব্যাদি ক্রয় করতে গেলে অতিরিক্ত টাকা নেয়া, বড় চৌকাতে ঠিকমতো আসামীরা খাবার পায় না, সিগারেট-বিড়ি না দিলে গোসল করতে গেলে পানি কম দেয়া, নগরীর বন্দীদের সামান্যতম ভুল হলে সংশোধন না করে অন্যায়ভাবে মারধর করা, মেডিকেল রাইটাররা ঘুমের ওষুধের পাশাপাশি নেশাকর দ্রব্য বিক্রি করে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, কোন নতুন বন্দী যদি কারাগারে যায় তাহলে ৯ থেকে ১০ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার কথা থাকলেও গোলাপ হোসেন দিলদার, পিতা-মুক্তার হোসেন, হাজতি নাম্বার- ৪৫০৮/২২ গত ২৪/০৩/২০২২ তারিখ কারগারে ঢুকলেও তাকে ২৮/০৩/২০২২ তারিখে কোয়ারেন্টাইন না মেনেই রাইটার তাসবির রহমান টাকা খেয়ে মেডিকেলে ভর্তি করেন।
এব্যাপারে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা’র সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভুক্তভোগীদের সকল অভিযোগ ডাহা মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আগে ছোট-খাটো অনিয়ম থাকলেও বর্তমানে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের সতর্ক করা হয়েছে। তিনি অবশ্য বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসরা কাউকে অসুস্থ বলে সুপারিশ করলে তার করার কিছু থাকে না। তিনি দাবি করেন, তার কড়াকড়ির কারনে ২০০ বেডের হাসপাতালে ৪০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তিনি আরও দাবি করেন, কোন এলাকাও নেশামুক্ত নয়। এদিকে গতকাল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল হাসপাতালে আনুমানিক ৭৮ জন রোগী ভর্তি ছিল। এদের ২৫ জনই সিস্টেম করে হাসপাতালের বেড দখল করেছিল। আর ৫জন সুপারিশের ভিত্তিতে। হাসপাতালে চিকিৎসক জুবায়েরের সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এব্যাপারে জেল সুপার ডাক্তার জুবায়েরের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ডাক্তার জুবায়ের ভালো ফ্যামিলির ছেলে, সে কোন অনিয়ম করতে পারেনা।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ দুদক ও আইন মন্ত্রণালয়ের জোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।