নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষায় আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
রোববার রাত ১২টার দিকে এ বিষয়ে দৈনিক বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান।
এর আগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া নিয়ে কলাবাগান থানা পুলিশ নানা তথ্য দেয়। ছেড়ে দেয়ার অল্প সময় আগেও পুলিশ জানায়, শুধু রত্নার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তার ছেলেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এর পর পরই তারা এই বক্তব্য থেকে সরে আসেন।
এ বিষয়ে রাত সোয়া ১২টার দিকে জানতে চাইলে এসি শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘মামলা হয় নাই। সিদ্ধান্তটা হচ্ছে এ রকম, যেহেতু তিনি একটা মুচলেকা দিছেন, তিনি ভুল বুঝতে পারছেন। তিনি সরকারি কাজে আর বাধা দিবেন না। এ কারণে মা ও ছেলেকে তার পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
একটু আগে বললেন যে মামলা হয়েছে। এমন তথ্য কেন দিলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাই এইটা আসলে কী করার। আপনি তো বুঝেন সব কিছু। সিচুয়েশনেগুলো সবার সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। ওই সময় পর্যন্ত তিনি অনমনীয় ছিলেন। পরে তিনি তার অথরিটির সঙ্গে কথা বলে একটা নমনীয় অবস্থান নিয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে আমরা মামলা গ্রহণ করি নাই।’
তিনি বলেন, ‘ওই সময় পর্যন্ত আমি আপনাকে যে আপডেট দিয়েছি সেটা ছিল রিয়েল। এখন আপডেট দিয়েছি, তাদের অলরেডি ছেড়ে দিয়েছি।’
এর আগে রোববার সকালে কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনে থাকা সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে আটক করে পুলিশ। এই মাঠে কলাবাগান থানার ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে।
সকালে তেঁতুলতলা মাঠ থেকে তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে সৈয়দা রত্না ফেসবুকে মাঠে ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে লাইভ করছিলেন। লাইভ দেয়ার সময় তাকে আটক করা হয়।
সকালে পুলিশ জানায়, সরকারি কাজে বাধা দেয়ার জন্য দুই জনকে আটক করা হয়েছে।
কলাবাগানের বাসিন্দারা জানান, তেঁতুলতলা মাঠের এক বিঘা জমি এক জন বিহারির মালিকানায় ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। সেই জায়গাটিতে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করত।
সরকারি খাস জমি হিসেবে নথিভুক্ত এই ফাঁকা জায়গাটিতে থানা করতে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আর এর পর থেকেই সেই জায়গাটি খেলাধুলার জন্য ফাঁকা রাখার দাবি উঠেছে।
কলাবাগানে সিটি করপোরেশনের একটিমাত্র খেলার মাঠ আছে। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পাশেই সেই মাঠ।
এর আগে ঘটনার বিবরণ দিয়ে সৈয়দা রত্নার মেয়ে শেউতি শাহগুফতা দৈনিক বাংলাকে বলেছিলেন, ‘গতকাল রাত একটার দিকে মাঠে ট্রাক নিয়ে আসে ইট, সুড়কি ফেলার জন্য। সকাল থেকে মাঠে ইট, সুড়কি ফেলা শুরু হয়। আম্মু সকাল ১০টার দিকে বের হয়ে মাঠের এখান থেকে একটা লাইভ করেন। তখন এক কথা দুই কথায় পুলিশ মাকে ধরে পুলিশ ভ্যানে ওঠায়।
‘বেলা ১০টা ৫৩ মিনিটে আমার ছোট ভাই ঈসা আব্দুল্লাহ আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, বুবু আম্মুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এ কথা বলে সে ফোন কেটে দিল। আমি তাকে ফোন ব্যাক করতে করতে তখন ও বলল বুবু আমাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এর পর দুইবার ফোন দিলাম ফোন কেটে দিল। এর পর থেকে আমার ভাইয়ের ফোন বন্ধ।’
তিনি আরও বলেছিলেন, “আম্মুকে নিচতলায় একটা রুমে আটকে রেখেছে পুলিশ। থানায় কথা বলতে গেলে কলাবাগান থানার ডিউটি অফিসার বলেছেন, ‘ম্যাডাম আমার কোনো দোষ নাই। ওপর থেকে তাদের দুইজনকে আটকে রাখতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে কথা বলতে হলে ওপরের কারও সঙ্গে কথা বলুন।’ তবে থানায় কথা বলার মতো ওসি, পরিদর্শক কেউই নাই।
‘আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আমার ভাই ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। তার বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাকে গারদে না রেখে বাইরে বসান। সে রোজা আছে। এই গরমে অসুস্থ হয়ে যাবে। এ ছাড়া তার ওপর একটা বাজে প্রভাব পড়বে। তারা (পুলিশ) বলে আমাদের কিছু করার নাই। সে ভেতরেই থাকবে। পরে একটা স্ট্যান্ড ফ্যান দেয়া হয়েছে। ওসি সাহেবকে অনেকবার ফোন দেয়া হয়েছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠ, থানা কোথাও পেলাম না তাকে।’
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে বেলা সাড়ে ৩টায় গিয়ে দায়িত্বরত কাউকেই পাওয়া যায় না। ওসির রুম বন্ধ পাওয়া যায়। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে থানা থেকে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
আটকের বিষয় নিশ্চিত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ) মো. ফারুক হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘কলাবাগান থানার জায়গাটা সরকারের পক্ষে ঢাকার ডিসি এটা অধিগ্রহণ করে পুলিশের নামে বরাদ্দ দিয়েছে। এই জায়গার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ২৭ কোটি টাকা ইতিমধ্যে সরকার নিয়েছে। এই জায়গা বাংলাদেশ পুলিশের বরাদ্দ হওয়ার পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে দেয়া হয়েছে কলাবাগান থানা করার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘জায়গা যেহেতু ফাঁকা পড়ে রয়েছে, বাচ্চাদের খেলার কথা অমুক তমুক বলে একটা গ্রুপ আছে যারা মামলা করে দেয়। এদিকে ফাইন্যান্স আসছে, কিন্তু কাজ শুরু করতে পারে না। যারা থানা করার জন্য সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছে, তাদেরকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।’
আটক দুজনের বিরুদ্ধে মামলা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা হতেও পারে। আবার জিজ্ঞাসাবাদ করেও ছেড়ে দিতে পারে।’
দীর্ঘদিন জায়গাটির মালিক না থাকায় দফায় দফায় দখলের চেষ্টা হয় বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দা রত্না।
রত্না আটকের আগে বলেন, ‘প্রভাবশালীরা এ মাঠটি বারবার দখলের চেষ্টা করেছে। স্থানীয়রা সেটা প্রতিহত করেছে। এখন পুলিশ দখল নিয়েছে। আমরা বিচারের জন্য যাদের কাছে আশ্রয় নিতাম, তারাই দখল নিয়েছে।’
সৈয়দা রত্না বলেন, ‘আমাদের এই এলাকায় আর কোনো মাঠ নেই। আমি, আমার পূর্ব প্রজন্ম ও পরের প্রজন্ম সবাই এই মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছে। শিশুরা খেলার মাঠ না পেলে কোথায় যাবে?’
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় মেয়র প্রতিটি এলাকায় মাঠ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন দেখছি, যেটা আগে থেকেই মাঠ ছিল সেটা এখন দখল করা হচ্ছে সরকারিভাবে। যদিও সিটি করপোরেশন বলছে এই মাঠটি তাদের নয়। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশকে থানার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’
কোনো পরিস্থিতিতেই এ মাঠটি দখল হতে না দেয়ার কথা জানান সৈয়দা রত্না। তিনি বলেন, ‘এই মাঠ দখল হয়ে গেলে এলাকায় শিশু-কিশোররা খেলবে এমন কোনো আর মাঠ থাকবে না। আমাদের সন্তানরা কোথায় খেলতে যাবে? তাদের বিকাশের জন্য এই খেলার মাঠটি প্রয়োজন। মাঠ বন্ধ করে কেন স্থাপনা করতে হবে? আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তেঁতুলতলা মাঠটি রক্ষা করা প্রয়োজন।’