নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ নদী আছে, নৌকাও আছে, শুধু নেই মাঝি। তাই নদের দুই ধারে বাঁশ গেড়ে টাঙানো হয়েছে রশি। পারাপারের জন্য ঘাটে বাঁধা নৌকায় চড়ে রশি ধরে টানলেই চলতে শুরু করে নৌকা।
ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দা উপজেলার ১০ গ্রামের প্রায় ১৬ হাজার মানুষ প্রতিদিন এভাবেই কুমার নদ পার হয়ে কাজে যান।
জানা গেছে, সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া কুমার নদের ওপর সেতু নির্মাণের অভাবে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দুই পাড়ের গ্রামের বাসিন্দারা। রশি টেনে টেনে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে নদ পার হচ্ছে নারী, শিশু, শিক্ষার্থী, বয়স্কসহ সবাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, সালথার মাঝারদিয়া গ্রাম ও নগরকান্দার লস্করদিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে কুমার নদ। নদের পশ্চিম পাড়ে সালথা আর পূর্বে নগরকান্দা উপজেলার সীমানা। নদের মধ্যে একটি কাঠের নৌকার দুই মাথায় রশি বাঁধা, তবে কোনো মাঝি নেই। সাধারণ মানুষ নৌকায় উঠে নিজেরাই রশি টেনে টেনে পারাপার হচ্ছেন।
এ সময় কয়েকজন জানান, পুরুষরা পারাপারের সময় শিশু, শিক্ষার্থী ও নারীদের পার করে দেন। তাই তাদের পারাপারের জন্য পুরুষের অপেক্ষায় পাড়েই বসে থাকতে হয় তাদের।
এর মধ্যে ভোগান্তি আরও বাড়ে যখন দেখা যায় যাত্রী এপারে আর নৌকা ওপারে। নৌকা ছাড়া নদ পাড়ি দেয়া সম্ভব না হওয়ায় তাদের অপেক্ষায় থাকতে হয় ওপার থেকে কোনো যাত্রীনৌকা এপারে না আনা পর্যন্ত। এভাবেই পেরিয়ে গেছে ৫০টি বছর।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওই জায়গায় নদের প্রশস্ততা আনুমানিক ১১০ মিটার। নদের দুই দিক কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। মাঝের কিছু জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যেই একটি নৌকা রাখা, তাতেই পার হতে হয়।
এলাকাবাসীর কয়েকজন জানান, সালথার মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কুমারপট্টি, খলিশপট্টি, মাঝারদিয়া, নারানদিয়া, মুরাটিয়া, তুঘুলদিয়া গ্রাম এবং নগরকান্দার লস্করদিয়া ইউনিয়নের কল্যাণপট্টি, আইনপুর, কুমারকান্দা ও বাগাটা এই ১০টি গ্রামের অন্তত ১৬ হাজার লোকের পারাপারের এটিই অন্যতম পথ।
তারা জানান, নগরকান্দা উপজেলার কল্যাণপুট্টি, কুমারকান্দা, আইনপুর ও বাঘুটিয়া গ্রামের তিন দিকেই কুমার নদে ঘেরা। একদিকে রয়েছে স্থলপথ, সেই পথ আবার অনেক দূরের। নিত্যপ্রয়োজনে বা বাজার করতে কাছের সালথা উপজেলার মাঝারদিয়া বাজারেই যেতে হয় তাদের। এ ক্ষেত্রে নৌকা ছাড়া পারাপারের অন্য কোনো পথ নেই তাদের।
নদের দুই পাড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক পাড়ে রয়েছে এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় মাঝারদিয়া বাজার। স্থানীয় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারজাত করেন এই বাজারে।
নগরকান্দার ওপারে আইনপুর দাখিল মাদ্রাসা, আইনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সালথার এপারে রয়েছে মাঝারদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, মাঝারদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নৌকায় নদ পার হতে হয়। বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীরা বেশি ঝুঁকি নিয়ে নদ পার হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়।
তাই স্থানীয়দের মাঝারদিয়া কুমার নদের ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের দাবি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে, তবে তা পূরণ হয়নি।
নগরকান্দার কুমারকান্দো গ্রামের জন্নাতী হোসেন রাফসা বলেন, ‘কলেজ খোলা থাকলে মাঝেমধ্যেই ঘাটে এসে বসে থাকতে হয়। রশি টেনে নৌকা পার হতে পারি না তাই পুরুষদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বর্ষাকালে প্রবল স্রোতে আরও বিপাকে পড়তে হয়। অনেক সময় ঘাটে অপেক্ষার পর কলেজে গিয়ে দেখি ক্লাস শেষ।’
কল্যাণপুটি গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই নদের দুই পাড়ের ঘাটে অনেক সমস্যায় পড়তে হয় কাদায়। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও গ্রামগুলোতে অ্যাম্বুলেন্স আসতে পারে না, রোগীকেও নৌকায় করে পার করে নিতে হয়।’
নারানদিয়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. ইদ্রিস মাতুব্বর বলেন, ‘শত বছর ধরে প্রতিদিন এই ঘাটে রশি টেনে নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন দশ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। কৃষকরা মাথায় করে ফসল এনে ঘাটে এসে নৌকা দিয়ে পার হয়ে বাজারে আসেন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।’
মাঝারদিয়ার বাজার কমিটির সভাপতি মো. সেলিম মাতুব্বর বলেন, ‘কুমার নদের ঘাটে সেতু নির্মাণে কয়েকবার জনপ্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।’
সালথা উপজেলা প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান বলেন, মাঝারদিয়া কুমার নদের ঘাটে একটি সেতুর খুব প্রয়োজন বলে স্থানীয় কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন। আমাদের কাছে ১০০ মিটার সেতুর প্রকল্প আসছে। নদের ওই ঘাটটি মেপে দেখব। ১০০ মিটার হলে সেতু নির্মাণ করতে পারব।’