পরিমল কুমার,ঢাকা ব্যুরো ঃ তিন স্তরে ভ্যাট কমার সুবিধা নিয়েও ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে চাইছেন আমদানিকারক ও মিলাররা। লক্ষ্যপূরণে তারা সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহে অনীহা দেখাচ্ছেন।
আমদানিকারক ও মিলারদের দাবি, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দামের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি এবং পাম তেল রপ্তানিতে ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের বাজারেও দর সমন্বয় করতে হবে।
রাজধানীসহ সারা দেশে এখন সয়াবিন ও পাম তেলের টান। ক্রেতারা তেলের খোঁজে ঘুরছেন বাজারে কিংবা অলিগলি বা পাড়ামহল্লার মুদি দোকানে, কিন্তু সেসব দোকানে মিলছে না কোনো তেল।
১০ দোকান ঘুরে কোনো একটিতে পাওয়া গেলেও সেখানে মিলছে শুধু ৫ লিটারের বোতল। সেটিও কিনতে হলে গুনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের (৭৬০ টাকা) চেয়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি। সরবরাহ তলানিতে নেমেছে এক-দুই লিটারের বোতলজাত তেলের।
খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এরপরও যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তাও লিটারপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রায় বিক্রেতাদের বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ মুদি দোকানি এখন দোকানে তেলই তুলছেন না।
মিলারদের দাবি, লিটারপ্রতি ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে তারা আর ব্যবসা করতে চান না। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে বাড়াতে হবে তেলের দাম। তার আগ পর্যন্ত ঘাটতি দূর হবে না।
রমজানের আগে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত বাজারে ভোজ্যতেলের নির্ধারিত দাম মেনে চলা এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মিলাররা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি তারা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
ভোজ্যতেলের মাত্রাতিরিক্ত দাম এবং ঘাটতি পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এখন ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতিতে দেশ।
দেশে সয়াবিন ও পাম তেলসহ সব ধরনের ভোজ্যতেলের দৈনিক সরবরাহ দরকার প্রায় ৭ হাজার টন, কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি কারখানা পর্যায় থেকে সরবরাহ দিচ্ছে দৈনিক ৩ থেকে ৪ হাজার টনের মতো।
এ মুহূর্তে দেশে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি নেই; বরং সয়াবিন ও পাম তেল চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। মজুত তেল আছে আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর গুদাম, কারখানায় এবং তাদের পরিবেশকদের হাতে।
বন্দরেও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে সয়াবিন ও পাম তেল। এর বাইরে বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় সমুদ্রপথে রয়েছে আরও কয়েকটি তেলবাহী জাহাজ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে, তা দিয়ে কমপক্ষে আরও দুই মাস চলার কথা। অপরদিকে বিশ্ববাজার থেকে বর্তমানে যে তেল আমদানি হবে, তা দেশে আসতে আরও দুই মাস লাগার কথা। আবার তা দেশে আসার পর কারখানায় পরিশোধিত হয়ে বাজার পর্যায়ে সরবরাহ হতে আরও দেড়-দুই মাস লেগে যাবে।
ক্রেতাদের অভিযাগ, দেশে মজুত তেলের দাম সরবরাহ পর্যায়ে এখনই বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা হিসেবে মিলাররা সরবরাহ চেইনেই পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইআইটি অনুবিভাগ) এ কে এম আহাদ আলী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেশে কোনোভাবেই ভোজ্যতেলের সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। কেন এমনটি হচ্ছে, আমরা নানাভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেছি। ঈদের পর ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণী বৈঠক রয়েছে। আমরা ওই বৈঠকেই এসবের জবাব চাইব।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভোজ্যতেলের বিশ্ববাজার খুব অস্থিতিশীল অবস্থায় যাচ্ছে। প্রতিদিনই সেখানে দাম বাড়ছে। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া তাদের পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। বিকল্প বাজার থেকে আমদানির পথ তৈরি না করা পর্যন্ত আমরা এখনই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপে যেতে পারছি না।
‘কারণ তেলের আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানি দেশে খুব সীমিত। এদের বেশি চাপাচাপি করতে গেলে আমদানি বন্ধ করে দিলে বাজারে তখন আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হতে পারে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা বাজারে মনিটরিং জোরদার করেছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
‘অপরদিকে সরবরাহ চেইনে কোনো অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের টিম পুনরায় আমদানিকারক ও পরিশোধন কোম্পানিগুলোর কারখানায় অভিযান চালিয়ে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখছে। একই সঙ্গে বিকল্প বাজার থেকে সরকার ভোজ্যতেলের আমদানির পথও তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও কেন সরবরাহে ঘাটতি জানতে চাইলে ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা এককথায় বলেন, ‘আপনি ব্যবসা করলে কি লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন? কোম্পানিগুলোর কী দায় পড়েছে লিটারে ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে তেল সরবরাহের।’
বাজারে তেলের সরবরাহে ঘাটতির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ঈদের পর দাম সমন্বয় হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’
টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) সফিউল আতাহার তাসলিম বলেন, ‘বাজারে তেলের সরবরাহ হচ্ছে না বিষয়টি এমন নয়, তবে সরবরাহ কমেছে। তার পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।’
এ ঘাটতিকে যৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়ে মিলাররা যে এখনও তেল সরবরাহ করে যাচ্ছে, সেটিই বিস্ময়ের বিষয়।’
এ সময় তিনি বসুন্ধরা, সিটি, মেঘনা, টি কে গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকসানের চিত্রও তুলে ধরেন।
সফিউল দাবি করেন, ঈদের পর যত দ্রুত সম্ভব ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্ববাজারের এই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় দেশে দাম পুনর্নির্ধারণ না হলে স্থানীয় বাজারে পরিস্থিতিরও খুব একটা উন্নতি ঘটবে না।
ঢাকায় ক্রেতা কম, স্বাভাবিক নিত্যপণ্যের বাজার
এদিকে ঈদের লম্বা ছুটিতে ইতোমধ্যেই ফাঁকা হয়ে এসেছে রাজধানী। শনিবার এবং রোববারও গ্রামের উদ্দেশে রাজধানী ছাড়বেন অনেক মানুষ। সব মিলিয়ে রাজধানীতে বসবাসরতদের ৬০ শতাংশের বেশি এবার ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।
এরই প্রভাব পড়েছে কাঁচাবাজারগুলোতে। রমজানের শুরু থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাজারে যে উত্তাপ পরিলক্ষিত হয়েছে, শনিবার কার্যত তার দেখা মিলেনি।
ভোজ্যতেল ছাড়া রোজা ও ঈদ অনুষঙ্গে ব্যবহার্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য লেবু, শসা, টম্যাটো, কাঁচা মরিচ এবং মাছ-মাংস বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই। আলু, পেঁয়াজ, ডাল, আদা, রসুন ও ডিমের দামও স্থিতিশীল রয়েছে।
বাজারগুলোতে গরুর মাংস ৬৫০-৭০০ টাকা কেজি, খাসির মাংস ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা, ব্রয়লার ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা, পাকিস্তানি কর্ক ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, দেশি মুরগি আকারভেদে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
রামপুরা বাজারের মুদি দোকানি আবু তৈয়ব বলেন, ‘বেচাকেনা কমে গেছে। ক্রেতা কম। দিনের বেশির ভাগ সময়ই এখন বসে বসে মাছি তাড়াই।’
ঈদ সামনে রেখে তেল ছাড়া নতুন করে কোনো জিনিসের দাম বাড়েনি বলেও জানান তিনি।